একজন পুলিশ সুপার কে নিয়ে যখন এই ধরনের ঘঠনা

বাংলাদেশ

হুমায়ুন কবির মাসুদ শিকদার। ডেস্ক রিপোর্টঃ

ঘটনা -১.তিনি তখন বান্দরবান জেলার পুলিশ সুপার। একদিন দুপুরে তিনি দেখলেন তাঁর দুপুরের খাবারের বাটিতে দু’টুকরা মাংস বেশি। জেলার এসপি বলেই কী তাকে দু’টুকরো মাংস বেশি দেওয়া হলো? অতিরিক্ত এই সুবিধা নিতে তিনি নারাজ। তাৎক্ষণিক বাবুর্চিকে ডাকলেন। এরপরের প্রশ্ন, -কী ব্যাপর, আমার প্লেটে মাংস বেশি মনে হচ্ছে কেন?বাবুর্চিঃ না স্যার, আজ সবার ভাগেই একটু বেশি করে পড়েছে।
-আচ্ছা তাহলে আরেকটা বাটি আমার কাছে নিয়ে আসো।
বাবুর্চি আরেকটা বাটি নিয়ে আসলেন।
এসপি: এই বাটিতেতো দু’টুকরা মাংস। তাহলে আমার বাটিতে চার টুকরা কেন?
বাবুর্চি ভড়কে মাথা নিচু করলেন।
এসপি সাহেব বললেন, আমার বাটি থেকে দু’টুকরা নিয়ে যাও। আর কোনদিন বেশি দিবা না। একজন কনস্টেবলকে যতটুকু দিবে, আমাকে ঠিক ততটুকু দেবে।
ঘটনা ২: বান্দরবন নগরের কোলাহলমুক্ত, প্রাকৃতিক দৃশ্য আর হরেক রকমের বাহারি ফলের সমারোহ এই জেলায়। পুলিশ লাইনও তার ব্যতিক্রম নয়। ছোট-বড় নারিকেল গাছে প্রচুর নারিকেল ধরেছে।
একদিন লোক দিয়ে গাছের সমস্ত পাকা নারিকেল পাড়লেন এসপি। বললেন; দেখি আমাকে দু’টা নারিকেল দাও। জেলার পুলিশ সুপার নারিকেল খেতে চেয়েছে শোনে সবাইতো চরম খু্শি।
পরে তিনি দু’টা নারিকেল নিলেন এবং তার সমমূল্য পরিশোধ করলেন এবং বাকি নারিকেল বিক্রি করে সমস্ত টাকা সরকারি কোষাগারে জমা দিলেন।
একজন পুলিশ সুপারকে নিয়ে যখন এই ধরনের ঘটনা শুনে ভীষণ মুগ্ধ হচ্ছিলাম। এই দেশে অনেক পুলিশের বিরুদ্ধে যখন নানা অভিযোগ তখন এমন অসাধারণ সৎ মানুষের কথা শুনতে আসলেই দারুণ লাগে। গত কয়েকদিন ধরে পুলিশের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার স্মৃতিচারণ দেখলাম মানুষটাকে নিয়ে। কয়েকটা উল্লেখ করছি।
ঘটনা ৩: যখন ছুটিতে বাড়ি যেতেন, সরকারী কোন প্রটোকল নিতেন না। একবার বাড়িতে যাওয়ার সময় বাসস্টপেজ পর্যন্ত এগিয়ে দেওয়ার জন্য সবাই ড্রাইভার কে রিকোয়েস্ট করলেন। কিন্তুু তিনি বললেন, এ গাড়িটা সরকার আমাকে সরকারি কাজের জন্য দিয়েছে, ব্যক্তিগত কাজের জন্য নয়। পরে বাসস্টপেজ পর্যন্ত তিনি সিএনজিতে করে গেলেন।
আমি আসলেই মুগ্ধ হয়েছি এই ঘটনায়। এই দেশের নিউমার্কেটে যান, বাজারে যান, স্কুল-কলেজে যান, রেলস্টেশনে যান! দেখবেন সরকারের সব জরুরী কাজে নিয়োজিত গাড়ি! এই দেশের অনেক সরকারি কর্মকর্তা যখন নিজের গাড়িটাকে শুধু ব্যক্তিগত কাজে না, স্ত্রী-সন্তানদের সেবায় নিয়োজিত করেন, তখন একজন পুলিশ কর্মকর্তা যদি আসলেই এমন হন, তাঁর সততা মুগ্ধ করে।
বলছি বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত আইজিপি নাজিবুর রহমান, এনডিসি, পিএইচডির কথা। সদ্য তিনি অবসরে গিয়েছেন।বাংলাদেশ পুলিশ একাডেমী সারদার প্রিন্সিপালের দায়িত্বে ছিলেন অতিরিক্ত এই আইজিপি। তাকে নিয়ে সেখানকার পুলিশ ছাত্ররা বলেছেন, আইজিপির পর পুলিশের এতো বড় পদে কর্মরত থেকেও তিনি ছিলেন ভীষণ বিনয়ী। একজন মানুষ কতটা সৎ, বিনয়ী আর আদর্শবান হতে পারেন তার উদাহরণ তিনি। পুলিশের এক কর্মকর্তা লিখেছেন, বলেছেন ভোরে পিটিতে যাওয়ার সময় স্যারকে পেতাম ফজরের নামাজে।স্যারের একটা করল্লা গাড়ি ছিল। যেখানে এসপিরা পাজেরো গাড়ি চালাতেন
সেখানে তিনি অতিরিক্ত আইজিপি হয়েও করল্লা গাড়িতে চড়তেন। ড্রাইভার ছিল না!স্যার নিজেই ড্রাইভ করতে দেখতাম। হাত উঁচু করে প্রত্যেকের সালাম নিতেন। মুখে থাকতো মুচকি হাসি।
ভীষণ অমায়িক মানুষ ছিলেন তিনি! একাডেমিতে প্রিন্সিপালের বাসভবনে সেই ঐতিহাসিক ছোট কুঠিতে তিনি বাস করতেন না। সব সময়ই দেখতাম নিজের কাপড় তিনি নিজেই ধুতেন।এমন কি স্যারের মায়ের মায়ের কাপড় ও। পাবলিক পরিবহন ব্যবহার করতেন। ট্রেনে করে যাতায়াত করতেন। ক্যাডেটরা ট্রেনিংয়ে থাকা অবস্থাতেই ছুটি থেকে আসার সময় স্যারকে ট্রেন জার্নিতে পেত। সেল্ফি তুলতো
কী মানুষ রে বাবা! অভিবাদন নেওয়ার জন্য যখন ডায়েচে আসতেন সিনা তিন ইঞ্চি বড় হয়ে যেত! স্যারকে স্যালুট দিতে পেরে গর্ব হত । স্যার যখন প্যারেড মাঠে আসতেন সারদার ৪৩° তাপমাত্রা কিছুই মনে হত না। স্যার যখন ডায়াসে দাঁড়িয়ে কথা বলতেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম।
বহু পুলিশ কর্মকর্তা লিখেছেন, সারদার তপ্ত রোদে যখন স্যারের কণ্ঠে ” আমার সন্তানেরা” শব্দটি প্রতিধ্বনিত হত তখন যেন শরীরের মধ্যে নতুন উদ্দীপনা তৈরি হত।
সারদার প্রিন্সিপাল থাকাকালীন বহু কৃতিত্ব রেখেছেন তিনি। সারদার মাটিতে উৎপাদিত ফলমূল ও পুকুরের চাষকৃত মাছ কনস্টবল থেকে উর্ধ্বতন কর্মকর্তা পর্যন্ত সমহারে বণ্টন করতেন।
স্যার সবসময় একটা ডায়ালগ বলতেন- “পুলিশ হচ্ছে শ্রেষ্ঠ মানুষ, পুলিশিং শ্রেষ্ঠ পেশা”। সারদায় পুলিশ একাডেমিতে স্যার যখন প্রিন্সিপ্যাল ছিলেন, স্যারের আপ্যায়ন বিলের লক্ষাধিক টাকা নিন্মপদস্থ সকল পুলিশের মধ্যে বন্টন করে দিতেন। নিজের আপ্যায়ন বিল এমনকিকি সোর্স মানি সকলের মাঝে বিলি করতেন। একজন শীর্ষ কর্মকর্তা প্রত্যেক সহকর্মীর প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি একই সত্যিই বিরল। স্যারের ছাত্র হিসাবে বলতে পারি স্যার শুধুই অনুকরণীয় ও শিক্ষনীয় ব্যক্তিত্ব।
সাদাসিধে জীবন যাপন করা এ মানুষটা দু’দিন আগে অবসরে চলে গেলেন। তার ছাত্ররা বলেছেন সত্যি মিস করবো স্যারকে। মিস করবো সারদা একাডেমির মাস্টার প্যারডে “আমার সন্তানেরা” বলে ডাকা সম্বোধনকে। নিশ্চয়ই স্যার পুলিশ বাহিনীর জন্য এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।
আমার চোখ ভিজে যাচ্ছিল। কী অসাধারণ মানুষ। আরেকটু বোঝার জন্য গুগলে সার্চ দিয়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে তাঁর দেওয়া বক্তব্য খুঁজছিলাম গণমাধ্যমে।
২০১৮ সালের জানুয়ারিতে প্রশিক্ষণ শেষে সারদায় নিয়োগ পাওয়া নতুন পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশ্যে তিনি বলছেন, জনগণ নির্যাতনের বিচার চাইতে এসে তোমাদের (পুলিশ) কাছে যেন নিরাশ না হয়। মনে রাখবে পুলিশ কোনো কিছুর বিচার করে না, তবে বিচারের খুঁটি হিসাবে কাজ করে।
নতুন পুলিশ সদস্যদের উদ্দেশে তিনি বলেন, জনগণের জান-মালের নিরাপত্তার দায়িত্ব তোমাদের উপর অর্পণ করা হলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *