রাকিব হোসেন মিলন, নিজস্ব প্রতিবেদক
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের করিডোর দিয়ে হাঁটলে জীবনবোধের মাত্রা অনেকটাই বদলে যায়। ছবির মতো সুন্দর জীবনের গল্প এসে থমকে গেছে এখানে।
বেদনার নীল রং আর হতাশায় ফ্যাকাশে হওয়া বাস্তবতার ছড়াছড়ি চারদিক। মৃত্যু, আর্ত কন্ঠের চিৎকার আর নানা সীমাবদ্ধতায় স্বস্তি এখানে কষ্টকল্পনা। অসুস্থ মানুষগুলোর অবস্থা হয় এখানে দূর্বিষহ স্বপ্নের মতো।প্রচন্ড পেরেশানি তে সময় কাটে রুগী ও আত্নীয়দের।এ যেনো কারবালার প্রান্তর….
হাসপাতাল এলাকায় সময়গুলো কাটতে থাকে সীমাহীন অস্থিরতায় । থাকতে হয় কিন্তু থাকতে ইচ্ছে করে না। ছুটতে হয় কিন্তু ছোটাছুটির পর মেঘ কেটে যাওয়ার আশ্বাসটুকু মেলে না। দীর্ঘ একটা দুঃস্বপ্ন মনে করে আশাবাদী মানুষগুলো ভাবতে থাকে এই কয়েক মূহুর্তের মধ্যেই বোধহয় শেষ হয়ে যাবে এই দমবন্ধ হওয়া ক্ষণ।মনে হতে থাকে এই বুঝি রুগীটা সুস্থ হয়ে উঠবে। জীবন আবার আলো ঝলমলে হবে।
যতটা কষ্টের মাঝে থেকে জীবনটা কোনোভাবে টেনে নেওয়া যায় এর চেয়ে বেশি যাতে না হয় বেদনার ভার। কেউ কেউ এই ভয়ানক ঘোর অমানিশায় গভীরভাবে খুজে চলে আল্লাহর করুণাধারা আবার কেউ কেউ এতো দুঃখের চাপে অভিমান করে দুরে সরে যায় আনুগত্যের শৃঙ্খল ভেঙে।
এমন করে একেকজন মানুষ বেঁচে থাকে একেকটা গল্পের চরিত্র হিসেবে। যেই গল্পের সমাপ্তি কী আনন্দের না কী শেষকালে ট্রাজেডির তীব্রতায় ভরপুর কেউ জানে না।এর উত্তর বলা নিদারুণ কঠিন।
আনোয়ার হোসেন ২০ বছরের টগবগে যুবক ছেলে। বাড়ি লক্ষ্মীপুরের নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকা রামগতি উপজেলায়।ইতোমধ্যে দুইবার ভেঙ্গেছে তাদের বসত বাড়ি। বাবার বড় ছেলে বলে ছোট্ট মুদি দোকানের ব্যবসা এখন তাকেই দেখতে হয়।প্রান্তিক নদী উপকূলীয় মানুষ প্রচন্ড আবেগী বলে নাতি-নাতনীর মুখ দেখতে চান তাই বাবা সখ করে বিয়ে করিয়েছেন বছরখানেক আগে আনোয়ার কে। নতুন সংসার আর ব্যবসা নিয়ে ভালোই চলছিলো সংসার। কাজের চাপ আছে কিন্তু ক্লান্তি নেই। টানাপোড়েন আছে কিন্তু অপ্রাপ্তির দুঃখবোধ নেই। এর মধ্যে সন্তানের আগমনী বার্তা পুরো পরিবারেই আনন্দের ঢেউ বইয়ে দিয়েছে। এমন করে সুন্দর একটা ছবির মতো স্বাভাবিক ভাবেই চলছিলো তাদের জীবন।
একদিন বন্ধুর মটরসাইকেলের পেছনে বসে বাড়ি থেকে বাজারে যাচ্ছিলো সে। বন্ধুর কোন ভুল ছিল না কিন্তু ওপার থেকে একটা মোটরসাইকেল এসে তাদের ওপর চড়ে বসে।
ভাগ্যের ফেরে বন্ধুর কিছু না হলেও আনোয়ারের ডান পা পুরোটাই থেতলে যায়। প্রচণ্ড রক্তপাত হতে থাকে। নিয়ে আসা হয় ঢামেক হসপিটালে।তাকে বাঁচাতে শেষ পর্যন্ত অপারেশন করে কেটে ফেলতে হয় একেবারে উড়ু পর্যন্ত। থমকে যায় দারুণ প্রাণচঞ্চল একটা জীবন। ওর পেশীবহুল সুদর্শন সুঠাম দেহের সাথে এমন কাটা পা একেবারেই বেমানান।
আনোয়ার সারাদিন মন খারাপ করে শুয়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সার্জারি ওয়ার্ডের বিছানায়। প্রচণ্ড ব্যাথা কমাতে তাকে দিতে হয় একের পর এক শক্তিশালী ঔষধ। এতে তবু না হয় তার শরীরের ব্যাথা কমলো কিছুটা কিন্তু মনের ব্যাথার কি হবে!!মনের ব্যাথা কমানোর কোন ঔষধ আবিষ্কার হয়েছে কি?
জীবন নিয়ে আজ সে হতাশ।জানি না ঠিক কোন ব্যাথাটা তাকে বেশী কাঁদায়। তার সামনে থাকা পঙ্গুত্ব নিয়ে ধুকে ধুকে বেঁচে থাকার বুকচাপা কষ্ট নাকি পরিবার, মা-বাবা ও সন্তানের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।
গল্পে গল্পে কথা হয় আরেকজনের সাথে। তার নাম আব্দুর রহিম। ঝিনাইদহ জেলা থেকে এসেছে।পবিত্র আল কুরআনের হিফয শেষ করেছে ১২ বছরের ছোট্ট আব্দুর রহিম। এলাকায় ভালো ছেলে হিসেবে তার সুনাম আছে। ছোট ছোট শিশুদের কোরআন শেখানো, মসজিদে নামাজ পড়ানো আর রমজানে মসজিদে তারাবীহ নামাজ পড়ানো এইসব করেই চলছিলো তার জীবন।কিছু দিন আগে পবিত্র ঈদুল ফিতরে ছোট্ট পরিসরে এলাকায় তরুনদের নিয়ে ইতিবাচক কিছু কাজ ও করেছে সে।সুবিধা বঞ্চিত মানুষদের মাঝে সামান্য পরিমান ঈদ সামগ্রী বিতরণ করেছে কিশোর আব্দুর রহিম ও তাঁর ইনোভেটিব টিম।তাঁর আত্নীয় স্বজনদের সাথে কথা বলে জানা যায় সমাজের মানুষের কাছে রয়েছে তাঁর ব্যাপক গ্রহনযোগ্যতা।
লেখা পড়া ভালো ভাবে করে বড় হওয়ার স্বপ্ন ছিলো আব্দুর রহিমের। আরো পড়ালেখা করে নিজেকে কিভাবে একজন আলেম হিসেবে তৈরি করা যায় সেই চিন্তাভাবনাই করছিলো সে। এই ঈদুল ফিতরের পর একদিন তার গাঁ কাপিয়ে জ্বর এলো। প্রচণ্ড জ্বর। চিকিৎসক বললেন তাঁর টাইফয়েড জ্বর হয়েছে । অনেকেরই জ্বর হয়; ভালোও হয়ে যায় কিন্তু এবারের ওর জ্বর হয়েছে ভয়াবহ আকারে।তার জ্বরের তীব্রতা বাড়তে লাগলো। অনেক চিকিৎসার পরও জ্বর কমার কোন লক্ষণ আসলো না।
সাম্প্রতিক জ্বরের জটিলতায় তার অন্ত্রে ফুটো হয়ে গেলো। শারীরিক অবস্থার অবনতি হতে লাগলো।ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এখন তাঁর জীবন কাটছে তীব্র বেদনায়।আব্দুর রহিম এখন আর আগের মতো প্রাণ চঞ্চল নেই। এমনি করে অনেক গতিশীল জীবনের হঠাৎ করে থমকে যাওয়া দৃশ্যের সাক্ষী হই আমরা গণমাধ্যম কর্মীরা।
হসপিটালের চিকিৎসকদের সাথে অবসরে আলাপ করে জানা যায় সড়ক দুর্ঘটনায় কোমর ভেঙে যাওয়া একজন গরীব বাবার ছেলে জাবেদ হোসেনের প্রস্রাব আর পায়খানার রাস্তা এক হয়ে গেছে। কি ভয়ংকর পরিস্থিতি প্রতিদিন ই চিকিৎসকদের কে সামলে নিতে হয়।বিছানায় নিজের প্রস্রাবের তীব্র ঝাঁঝালো গন্ধে সারা দিন শুয়ে থাকা জাবেদের সামনে দাঁড়ালে কিছু সময়ের জন্য স্তব্ধ হয়ে যেতে হয় বলছেন নার্সরা।এই তরুণের বাকী জীবনটা কিভাবে কাটবে?
দরিদ্র রিকশাওয়ালা বাবার কাঁধে চেপে বসা ভারী একটা বোঝা হিসেবে জাবেদ এখন উপনীত হয়েছে। হয়তো বাবা এই কিছুদিন আগেই ভাবছিলেন যাক ছেলে এখন বড় হয়েছে। কষ্টের দিন শেষ হয়ে এলো দিন আসবে।অথচ আজ বাবা বাকরুদ্ধ,হতবাক ও নিঃস্ব।
দারিদ্র যেনো আজীবনের সঙ্গী হয়েই থাকবে তাদের। কষ্টগুলোও হয়তো পিছু ছাড়বে না কোনদিন। এ মানবিক আবেদন স্পর্শী দৃশ্য সরাসরি চোখে না দেখলে হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করা বড়ই কঠিন।সীমিত আয়ের মানুষদের জন্য হঠাত করে কোনো বিপদ আসলে এমন বিপর্যস্ত হতে হয় যা ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন।
এমন অসংখ্য জীবনের নিদারুণ গল্প রয়েছে ঢাকা মেডিকেল সহো সারা দেশের হসপিটাল গুলোতে। অনাকাঙ্ক্ষিত ও অসহায় মূহুর্তে রোগীর পাশে দাঁড়ানো তো মানবিক কাজ।জীবনের এই আকস্মিক ছন্দপতনে হঠাৎ করেই তীব্র অসহায়ত্বের মুখোমুখি তারা।তীর ছাড়া সাগরে ভাসতে ভাসতে ভাঙা পাটাতন আকড়ে ধরার মতো তারা সমাজ ও রাষ্ট্রের কাছে এক সময় হাত পাতে।বিশেষ করে রাষ্ট্রের দায়বদ্ধতা এখানে অনেক বেশী।সমাজ ও রাষ্ট্র উদার হলে হয়তো রামগতির আনোয়ার,ঝিনাইদহের আব্দুর রহিম ও রিকশা চালক বাবার ছেলে জাবেদের সামনের জীবনের গল্প গুলো আরো সহজ ও মসৃণ হতে পারে।